ডিএনএন ডেস্ক: রাজশাহী বিভাগের আট জেলার ৩৯ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সোমবার বিকালে গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী জেলার ছয়টি আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও ছিলেন। এই ছয়টি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন অর্ধশতাধিক। তবে সীমিত সংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী গুলশান কার্যালয়ে ডাক পেয়েছেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মনোনয়নপ্রত্যাশী ডাক না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের সমর্থকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে চাপা ক্ষোভ এবং অসন্তোষ। তবে ক্ষোভ প্রকাশকারী মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং তাদের সমর্থকরা সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে মিডিয়ার সামনে নাম প্রকাশ করছেন না।
মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বলছেন, আমরা গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছি। দীর্ঘ সময় থেকে মাঠে রয়েছি। সাক্ষাৎকারের জন্য গুলশান কার্যালয়ে না ডাকায় কর্মী-সমর্থকদের কাছে আমাদের হেয় করা হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি দলীয় হাইকমান্ডের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও এলাকায় শুরু হয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। গুলশান কার্যালয়ের বৈঠকে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বশীল নেতারা পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তারা তাদের পছন্দের এবং কাছের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডেকেছেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং তাদের সমর্থকরা জানান, বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারের বিষয়টি অবগত করে আমন্ত্রিত মনোনয়নপ্রত্যাশীদের হোয়াটসঅ্যাপে দলের নির্দেশনা সম্বলিত মেসেজ দেন। এছাড়া মেসেজে তিনি সভায় অংশগ্রহণের জন্য বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দনের কাছ থেকে পরিচয়পত্র সংগ্রহের জন্য বলেন।
এর পরেই বিষয়টি নিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং তাদের সমর্থকদের ডাক পাওয়া এবং না পাওয়া নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। চলতে থাকে নানান বিশ্লেষণ। যেসব মনোনয়নপ্রত্যাশী ডাক পাননি তারা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। সোমবার বিকাল চারটা পর্যন্ত তারা হাল না ছেড়ে কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ নেতাদের মাধ্যমে তদবির করেন। তবে এক্ষেত্রে আমন্ত্রণবঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সফল হননি।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন অন্তত দশজন। এ আসন থেকে গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) শরিফ উদ্দিন, সুপ্রিমকোর্ট জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন, গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সদস্য শিল্পপতি সুলতানুল ইসলাম তারেক এবং জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব ও রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব।
এ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অধিকাংশই সাক্ষাৎকারের জন্য কেন্দ্রে ডাক পাননি। তাদেরই একজন রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গুলশান কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্বে ছিলেন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এক্ষেত্রে তারা চরম পক্ষপাতিত্ব করেছেন।
তবে এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নধর্মী যুক্তি দেখিয়েছেন এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাক্ষাৎকারে ডাক পাওয়া জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব। তিনি বলেন, যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী তাদের সবাইকেই গুলশান কার্যালয়ে ডাকা উচিত ছিল। আর মনোনয়নের ক্ষেত্রে দল যেটি সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিই চূড়ান্ত। দলের সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে নিতে হবে। সবাইকে ডাকলে দলীয় শৃঙ্খলা শক্তিশালী হতো। আর সবাই একসঙ্গে কাজ করার উৎসাহ পেতেন।
রাজশাহী-২ (সদর) আসন থেকে সাক্ষাৎকারের জন্য অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রাজশাহী সদর আসনের সাবেক এমপি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এবং মহানগর বিএনপির সদ্যবিদায়ি আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ইশা এবং রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। এই আসন থেকে সবাই সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রণ পাওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ কিংবা হতাশা লক্ষ্য করা যায়নি।
রাজশাহী-৩ (মোহনপুর-পবা) আসন থেকে অংশ নেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহসম্পাদক ও রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন। তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এই আসনে সাক্ষাৎকারে আরও অংশ নেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রায়হানুল আলম রায়হান এবং মোহনপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুস সামাদ। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশী আরও কয়েকজন ডাক না পাওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসন থেকে সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়েছেন বাগমারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন। এই আসনে বিএনপির এক ডজনের বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। এছাড়া অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আরও রয়েছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়া এবং জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে সাক্ষাৎকারের জন্য অংশ নেওয়া উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক কোষাধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা. বিএনপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সদস্য ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবিবা. পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি রুকনুজ্জামান আলম, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মন্ডল এবং সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফার ছেলে জুলকার নাঈম মোস্তফা বিস্ময়।
এ আসনেও ডজনখানেক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর বক্তব্য, বিভাগের দায়িত্বশীল নেতারা প্রত্যেকটি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে দল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়াদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ, বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক এবং রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল।
এ আসনটিতেও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা দশের অধিক। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে একজন বলেন, কেন্দ্রে আমন্ত্রণের জন্য যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের ব্যাপারে মুখ খুললে বিপদ আছে। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মন্তব্য করলে সাংগঠনিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তবে তারা শুধু নিজেদের লোকদেরই ডেকেছেন। দায়িত্বপ্রাপ্তরা দলের কথা না ভেবে নিজেদের লাভ-লোকসানের হিসাব কষেছেন। আগামী নির্বাচনে এর মাশুল দিতে হবে।
গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারবঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ক্ষোভের বিষয়ে জানতে বিএনপির রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকতের বক্তব্যের জন্য সোমবার সন্ধ্যায় ফোন দেওয়া হয়। তিনি ফোন না ধরায় বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেন, প্রত্যেকটি আসনেই মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতার সংখ্যা অনেক। মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের ডাকার ব্যাপারে হয়তো হাইকমান্ডের বিশেষ কোনো নির্দেশনা থাকতে পারে। তবে যারা সাক্ষাৎকারের জন্য মনোনীত হয়েছেন, তারাই মনোনয়ন পাবেন-বিষয়টি এমন নয়। দলীয় ভেদাভেদ এবং বিশৃঙ্খলা পরিহার করে নিজেদের মধ্যে ঐক্য অটুট রাখা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। (সূত্র-যুগান্তর)